রোজা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রমজান মাসে মুসলিমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পানাহার ও অন্যান্য জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত থাকে। তবে রোজা রাখার সময় কিছু বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি, যেমন কফ বা থুথু গিলে ফেলা। এ বিষয়ে ইসলামী শরীয়তের স্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। কফ গিলে ফেললে রোজা ভাঙবে কি না, তা নিয়ে ফিকহের বিভিন্ন মাজহাবের আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এখানে কুরআন, হাদিস এবং ফিকহের দলিলের ভিত্তিতে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা হলো।

-
সাধারণ নীতিমালা
- রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো বস্তু গলার নিচে প্রবেশ করালে রোজা ভেঙে যায়। তবে শরীরের অভ্যন্তরে উৎপন্ন পদার্থ (যেমন লালা, কফ বা থুথু) গিলে ফেলার বিধান ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে ফকিহগণ কফের উৎস ও অবস্থানের ভিত্তিতে রায় দিয়েছেন।
-
কফের ধরন ও ফিকহী বিধান
-
কফ মুখে আসার পর গিলে ফেলা: অধিকাংশ আলিমের মতে, কফ যদি মুখে চলে আসে এবং তা গিলে ফেলা হয়, তবে রোজা ভাঙে না। কেননা এটি শরীরের অভ্যন্তরীণ তরল, যা বাইরের কোনো বস্তু হিসেবে গণ্য হয় না।
হাদিসের দলিল: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,রোজা অবস্থায় তিনটি কাজ ক্ষমাযোগ্য: ভুলে কিছু খাওয়া-পান করা, স্বপ্নদোষ হওয়া ও বমি করা
(সুনান আবু দাউদ: ২৩৮৮)। এ হাদিসে বমি করাকে রোজা ভঙ্গের কারণ বলা হয়েছে, কিন্তু কফ গিলে ফেলার কথা উল্লেখ নেই। ফলে এটি সাধারণ নীতির অধীন। - কফ গলা থেকে টেনে মুখে এনে গিলে ফেলা: যদি কফ গলার গভীর থেকে টেনে উপরে আনেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেলা হয়, তবে কিছু আলিম (যেমন হানবলি মাজহাব) একে রোজা ভঙ্গের কারণ হিসেবে গণ্য করেন। এ ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃততা মূল বিষয়।
-
কফ মুখে আসার পর গিলে ফেলা: অধিকাংশ আলিমের মতে, কফ যদি মুখে চলে আসে এবং তা গিলে ফেলা হয়, তবে রোজা ভাঙে না। কেননা এটি শরীরের অভ্যন্তরীণ তরল, যা বাইরের কোনো বস্তু হিসেবে গণ্য হয় না।
-
মাজহাবভিত্তিক মতামত
- হানাফি মাজহাব: মুখে আসা কফ গিলে ফেললে রোজা ভাঙে না। তবে গলা বা বুক থেকে কফ টেনে এনে গিলে ফেললে তা মাকরুহ (অপছন্দনীয়) (ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়া: ১/২০২)।
- শাফিঈ মাজহাব: কফ মুখে আসার পর গিলে ফেললে রোজা ঠিক থাকে, তবে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে তা না গেলা উত্তম (আল-মাজমু: ৬/৩২৬)।
- মালিকি মাজহাব: মুখের কফ গিলে ফেললে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না (আশ-শারহুল কাবীর: ২/২৪৫)।
- হানবলি মাজহাব: ইচ্ছাকৃতভাবে গলা থেকে কফ টেনে গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যেতে পারে (আল-মুগনি: ৩/২৬)।
-
আলিমদের মূল্যায়ন
-
ইবনে তায়মিয়া (রহ.): তিনি উল্লেখ করেন,
কফ যদি স্বাভাবিকভাবে মুখে আসে এবং তা গিলে ফেলা হয়, তবে রোজা ভাঙে না। কিন্তু যদি কেউ ইচ্ছা করে গলা থেকে কফ টেনে এনে গিলে, তবে তা রোজা নষ্ট করে
(মাজমু আল-ফাতাওয়া: ২৫/২৬৬)। -
ইবনে উসাইমীন (রহ.): তিনি বলেছেন,
কফ গিলে ফেলা থেকে বিরত থাকা উচিত, তবে তা রোজা ভঙ্গ করবে না যদি তা মুখে এসে থাকে
(ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম: ৪৫১)।
-
ইবনে তায়মিয়া (রহ.): তিনি উল্লেখ করেন,
-
সিদ্ধান্ত
- রোজা অক্ষুণ্ণ থাকে: যদি কফ স্বাভাবিকভাবে মুখে চলে আসে এবং তা গিলে ফেলা হয়।
- রোজা ভঙ্গের সম্ভাবনা: যদি গলা বা বুক থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে কফ টেনে এনে গিলে ফেলা হয় (হানবলি মাজহাব অনুযায়ী)।
-
সতর্কতা
- কফ গিলে ফেলা এড়ানো উত্তম, তবে তা রোজা ভঙ্গের কারণ নয় বলে অধিকাংশ আলিমের মত। কোনো সন্দেহ থাকলে রোজা পরবর্তীতে কাজা করা যেতে পারে, তবে শর্ত হলো সুনির্দিষ্টভাবে দলিলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
রোজা রাখার সময় কফ গিলে ফেলা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন ও দ্বিধা তৈরি হয়। ইসলামী শরীয়তের আলোকে এ বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। সাধারণত মুখে আসা কফ গিলে ফেললে রোজা ভাঙে না, তবে গলা বা বুক থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে কফ টেনে এনে গিলে ফেললে তা রোজা ভঙ্গের কারণ হতে পারে বলে কিছু আলিম মত দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা এবং সম্ভব হলে কফ গিলে ফেলা থেকে বিরত থাকাই উত্তম।
রোজা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি মহান ইবাদত। তাই এ সময় আমাদেরকে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও ইখলাসের সাথে রোজা পালন করা উচিত। কোনো সন্দেহ বা দ্বিধা থাকলে ইসলামী স্কলারদের কাছ থেকে সঠিক দিকনির্দেশনা নেওয়া জরুরি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর বিধান মেনে চলার তাওফিক দান করুন এবং আমাদের রোজাকে কবুল করুন। আমীন।
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।
সুরা আল-বাকারা: ১৮৩
সুতরাং, রোজা শুধু ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণের বিষয় নয়; বরং এটি তাকওয়া অর্জন এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম। তাই রোজা রাখার সময় প্রতিটি কাজে সতর্কতা ও আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণের মনোভাব রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নের উত্তর
কফ গিলে ফেললে রোজা ভাঙবে কি?
সাধারণত মুখে আসা কফ গিলে ফেললে রোজা ভাঙে না। তবে গলা বা বুক থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে কফ টেনে এনে গিলে ফেললে তা রোজা ভঙ্গের কারণ হতে পারে বলে কিছু আলিম মত দিয়েছেন।
মুখে আসা কফ গিলে ফেলার বিধান কী?
মুখে আসা কফ গিলে ফেললে রোজা ভাঙে না। এটি শরীরের অভ্যন্তরীণ তরল হিসেবে গণ্য হয়, তাই এটি রোজা ভঙ্গের কারণ নয়।
গলা থেকে কফ টেনে এনে গিলে ফেললে কী হবে?
গলা বা বুক থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে কফ টেনে এনে গিলে ফেললে কিছু আলিম (যেমন হানবলি মাজহাব) একে রোজা ভঙ্গের কারণ হিসেবে গণ্য করেন। এ ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
কফ গিলে ফেলা কি মাকরুহ?
হানাফি মাজহাব অনুযায়ী, কফ গিলে ফেলা মাকরুহ (অপছন্দনীয়) তবে রোজা ভঙ্গের কারণ নয়। শাফিঈ ও মালিকি মাজহাবেও একই মত পাওয়া যায়।
রোজা রাখার সময় কফ গিলে ফেলা এড়ানো কেন জরুরি?
কফ গিলে ফেলা এড়ানো উত্তম, কারণ এটি রোজার পবিত্রতা ও সতর্কতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। যদিও এটি রোজা ভঙ্গের কারণ নয়, তবুও সতর্কতা হিসেবে এড়ানো ভালো।
যদি কফ গিলে ফেলার কারণে রোজা ভেঙে যায়, তাহলে কী করতে হবে?
যদি কফ গিলে ফেলার কারণে রোজা ভেঙে যায় বলে ধরে নেওয়া হয়, তবে সেই রোজাটি পরে কাজা করতে হবে। তবে এ বিষয়ে ইসলামী স্কলারদের কাছ থেকে সঠিক দিকনির্দেশনা নেওয়া জরুরি।
কফ গিলে ফেলার বিষয়ে হাদিসে কী বলা হয়েছে?
হাদিসে সরাসরি কফ গিলে ফেলার কথা উল্লেখ নেই। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "রোজা অবস্থায় তিনটি কাজ ক্ষমাযোগ্য: ভুলে কিছু খাওয়া-পান করা, স্বপ্নদোষ হওয়া ও বমি করা" (সুনান আবু দাউদ: ২৩৮৮)। এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, শরীরের অভ্যন্তরীণ তরল (যেমন কফ) গিলে ফেললে রোজা ভাঙে না।
রোজা রাখার সময় কফ বা থুথু ফেলে দেওয়া কি উত্তম?
হ্যাঁ, রোজা রাখার সময় কফ বা থুথু ফেলে দেওয়া উত্তম। এটি রোজার পবিত্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং কোনো ধরনের সন্দেহ এড়ানো যায়।
রোজা ভঙ্গের বিষয়ে সন্দেহ হলে কী করা উচিত?
রোজা ভঙ্গের বিষয়ে সন্দেহ থাকলে ইসলামী স্কলার বা আলিমের কাছ থেকে সঠিক দিকনির্দেশনা নেওয়া উচিত। সন্দেহের ভিত্তিতে রোজা ভেঙে ফেলা ঠিক নয়।